আচ্ছা বলুন তো, বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত নীরব ঘাতক ব্যাধি কোনটি? নিশ্চয়ই ডায়াবেটিস! আজকের দিনে সবচেয়ে মারাত্মক এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এটি। আমাদের আশেপাশের স্বজনদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, কেউ না কেউ এই রোগে আক্রান্ত। নিয়মিত যত্ন এবং সচেতনতা ছাড়া এই রোগ ধীরে ধীরে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। শুধু কি তাই? এটি হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, চোখের সমস্যার জন্যও দায়ী। ঘাবড়ে যাবেন না! কিভাবে দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায় যে সমস্ত তথ্যই বিস্তারিত আলোচনা করবো উক্ত ব্লগে।
ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস মেলিটাস যা সাধারণত ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। ডায়াবেটিস হলে দেহের অগ্ন্যাশয় প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না কিংবা শরীর এই উৎপন্ন ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়।
গ্লুকোজ হলো আমাদের দেহে এনার্জি বুস্টিং এর প্রধান উৎস। আমরা যেসব খাবার গ্রহণ করি তা থেকে গ্লুকোজ তৈরি হয়। আর এই ব্লাড গ্লুকোজ কিংবা ব্লাড সুগার যখন আমাদের দেহে অতিরিক্ত পরিমানে বেড়ে যায় তখন ডায়াবেটিস এর সমস্যা দেখা দেয়।
ইনসুলিন হলো এক ধরনের হরমোন যা দেহের অগ্ন্যাশয়ে তৈরি হয়। এটি গ্লুকোজকে কোষে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে এবং এই গ্লুকোজ পরবর্তীতে শক্তিতে পরিনত হয়৷ কিন্তু আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে আপনার শরীর সামান্য পরিমান ইনসুলিন কিংবা কোনো ইনসুলিন-ই তৈরি করবে না। এমতাবস্থায় গ্লুকোজ আপনার রক্তের সাথে অবস্থান করবে কোষে পৌঁছাবে না৷
ডায়াবেটিস কি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি?
অবশ্যই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। তা না হলে চোখ, নার্ভ, হার্ট, কিডনি ড্যামেজ এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে।
কি কি ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে?
সর্বমোট ৩ ধরনের ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। যেমন-
- টাইপ ১ ডায়াবেটিস
- টাইপ ২ ডায়াবেটিস
- গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস
১.টাইপ-১ ডায়াবেটিস
টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি হয় না। এ সময় অগ্ন্যাশয়ের যে কোষগুলো ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করতো সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। যদিও সব বয়সেই টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে কিন্তু শিশু ও তরুণদের ভেতর এটি বেশি দেখা দেয়। এ অবস্থায় ইনসুলিন নেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। এ সময় ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ডায়াবেটিসের ইনসুলিন গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত।
২.টাইপ-২ ডায়াবেটিস
এই ধরনের ডায়াবেটিসে শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারে কিন্তু তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়। এটি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা দেয়। এটি মূলত জীবন-যাপনের ধরন, অতিরিক্ত ওজন এবং বংশগতির জন্য হতে পারে। এমতাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর জন্য লাইফ-স্টাইলে পরিবর্তন আনতে পারেন। নিয়মিত শরীর চর্চা, খাদ্যাভ্যাস, ওজন কমানোর মাধ্যমে আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। তবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ডাক্তারের পরামর্শে ওরাল ডায়াবেটিস ওষুধ গ্রহণ করা ভালো। এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
৩. গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস:
এটি সাধারণত গর্ভাবস্থায় ঘটে। যেখানে গর্ভবতী মহিলাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণত গর্ভাবস্থার পর এটি ঠিক হয়ে যায় কিন্তু পরবর্তীতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাদ্যাভ্যাসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা জরুরি। নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো:
১.কম কার্বোহাইড্রেট: সাদা চাল, রুটি, এবং আলু পরিহার করুন। এর পরিবর্তে ব্রাউন রাইস, পুরো গমের রুটি খান।
২.ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার: সবজি, ফল, বাদাম এবং শস্য ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন যা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৩.প্রোটিন: মাছ, মুরগির মাংস, ডালের মতো স্বাস্থ্যকর প্রোটিন গ্রহণ করুন।
৪.স্বাস্থ্যকর চর্বি: বাদাম, অলিভ অয়েল, এবং অ্যাভোকাডো খেতে পারেন।
৫.চিনি এড়িয়ে চলুন: মিষ্টি পানীয়, ক্যান্ডি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার কমিয়ে ফেলুন।
৬.পর্যাপ্ত পানি পান করুন: শর্করা নিয়ন্ত্রণে পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭.ছোট কিন্তু ঘন ঘন খাবার: অল্প পরিমাণে কিন্তু ঘন ঘন খাবার খান যাতে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শারীরিক ব্যায়াম ও সক্রিয় জীবনযাপনের গুরুত্ব
শারীরিক ব্যায়াম এবং সক্রিয় জীবনযাপন শুধুমাত্র ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেই নয়, সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু কারণ ও পরামর্শ দেওয়া হলো:
১.শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিসসহ অনেক রোগের ঝুঁকি কমায়।
২.রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ: ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
৩.হৃদপিণ্ডের সুস্থতা: নিয়মিত ব্যায়াম হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৪.মনোরোগের উন্নতি: শারীরিক ব্যায়াম বিষন্নতা ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
৫.শক্তি বৃদ্ধি: ব্যায়াম শক্তি বাড়ায় এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে ফ্রেশ ও সক্রিয় রাখে।
পরামর্শ:
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটুন।
- দৌড়ানো, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা।
- হালকা ওজন তোলার ব্যায়াম করুন পেশীর শক্তি বাড়াতে।
- প্রতিদিন কিছু সময় স্ট্রেচিং করুন যাতে শরীরের নমনীয়তা বাড়ে।
- বাসার কাজ, বাগান করা, বা খেলার মধ্যে সক্রিয় থাকুন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ঘরোয়া উপায়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কিছু প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায় কার্যকর হতে পারে। তবে মনে রাখবেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ও নিয়মিত ওষুধ গ্রহণও অত্যন্ত জরুরি।
১.মেথি দানা: প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক গ্লাস পানিতে ভেজানো মেথি দানা খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে।
২.করলা: করলার রস রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়ক। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে করলার রস খান।
৩.জাম বীজের গুঁড়ো: জাম বীজ শুকিয়ে গুঁড়ো করে প্রতিদিন খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
৪.দারুচিনি: দারুচিনি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে এক চা চামচ দারুচিনি গুঁড়ো খেতে পারেন।
৫.আমলকী: আমলকীর রস রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে আমলকীর রস খান।
৬.তুলসী পাতা: তুলসী পাতা রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ২-৩ টি তুলসী পাতা চিবিয়ে খেতে পারেন।
স্ট্রেস কমানোর কৌশল
স্ট্রেস কমানোর কৌশলগুলি মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু কার্যকর কৌশল দেওয়া হলো:
১. নিজ ধর্ম অনুসারে স্রষ্টাকে স্মরণ করুন। মনে শান্তি বিরাজ করবে
২. নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। হাঁটা, দৌড়ানো, যোগব্যায়াম, সাইক্লিং কিংবা সাঁতার কাটতে পারেন।
৩. দৈনিক মেডিটেশন বা শ্বাস প্রশ্বাসের অনুশীলন করলে স্ট্রেস কমে যায় এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বাড়ে।
৪. পর্যাপ্ত এবং নিয়মিত ঘুম স্ট্রেস কমাতে সহায়ক। প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
৫. পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, কথা বলা এবং মানসিক সমর্থন পাওয়া স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
৬. নিজের পছন্দের কোনো শখের কাজ বা আগ্রহে নিজেকে নিয়োজিত রাখা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
৭. গাইডেড ইমেজারি বা কল্পনাশক্তির সহায়তায় একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কল্পনা করা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৮. মানসিক সমর্থনের জন্য পরামর্শদাতা বা থেরাপিস্টের সাথে কথা বলতে পারেন।
৯. কাজ ও বিশ্রামের মধ্যে একটি সুষম সময় ব্যবস্থাপনা রাখা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত ঘুমের গুরুত্ব
ভালো ঘুমই সুস্থতার চাবিকাঠি!
পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের মনকে শান্ত রাখে,স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ওজন বৃদ্ধি রোধে এটি অত্যন্ত কার্যকর। ঘুম আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি পুনরুদ্ধার করে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে আমরা ক্লান্তি ও অক্ষমতায় ভুগতে পারি। ভালো ঘুম আমাদের মেজাজকে স্থিতিশীল রাখে এবং মানসিক উদ্বেগ ও বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে। ঘুমের অভাবে আমাদের মানসিক চাপ বেড়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের সৃজনশীলতা বাড়ায় এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা উন্নত করে। এটি আমাদের মননশীল চিন্তা এবং ধারণা স্পষ্ট করে।
ঘুম, আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা শরীর এবং মন দুই-এরই পুনরুজ্জীবনের কাজ করে। তাই প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো উচিত।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাত্রার পরিবর্তন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি। বিশেষ করে খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কার্যকলাপ, ওষুধ ও ইনসুলিন, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পর্যাপ্ত ঘুম, ধুমপান বর্জন, জীবনযাত্রার পরিবর্তনসহ আরও অনেক বিষয় চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক করা উচিৎ।
এছাড়াও ডায়াবেটিস সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পড়ুন এই ব্লগটি। Click here!