মানুষের শরীরের পিঠের দিকটা যতটা সুরক্ষিত, পেটের দিকটা ততটা নয়। এখানে প্রাকৃতিক কিছু ছিদ্র বা দুর্বলতা আছে। কোনো কারণে পেটে বেশি চাপ পড়লে সেগুলো দিয়ে ভেতরের অনেক কিছু বের হয়ে আসতে পারে। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্বল কেন্দ্র হলো নাভি কিংবা ছেলেদের কুঁচকি। জন্মের আগে নাভির মাধ্যমে মায়ের শরীরের সঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর যোগাযোগ থাকে। কিন্তু জন্মের পরও ছিদ্রটি রয়ে যায়। আর ছেলেদের অণ্ডকোষ জন্মের আগে পেটের ভেতর থাকে পরে কুঁচকি দিয়ে অণ্ডথলিতে নেমে আসে। এখানেও তাই একটা পথ রয়ে যায়। এ দুটা ছিদ্রযুক্ত জায়গায় সে জন্য হার্নিয়া বেশি হয়।
হার্নিয়া কি ?
হার্নিয়া খুবই কমন একটি রোগ। পেটের অভ্যন্তরে রয়েছে বিভিন্ন অঙ্গ। সেই অঙ্গের কোনও অংশ পেটের কোনও পেশি বা কোষকলার দেওয়াল ঠেলে বেরিয়ে এলে বলা হয় হার্নিয়া।এই অসুখ হলে প্রচণ্ড ব্যথা (Pain) হয়। এমনকী মানুষ এই ব্যথার কারণে শয্যাশায়ী পর্যন্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে এই রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
হার্নিয়ার কেন হয় ?
১. ওবেসিটি।
২. প্রেগন্যান্সি।
৩. পেটের পেশিতে বেশি চাপ পড়া।
৪. খুব কাশি।
৫. বেশি ওজন তোলা।
৬. নিয়মিত কোষ্ঠকাঠিন্য।
৭. ধূমপান, অন্যান্য তামাকজাত পদার্থ খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি।
হার্নিয়া কত প্রকার ?
১. ফিমোরাল হার্নিয়া।
২. হায়াটাল হার্নিয়া।
৩. আমব্লায়াকাল হার্নিয়া।
৪. ইঙ্গুয়াল হার্নিয়া।
কিভাবে বুঝবেন আপনার হার্নিয়া হয়েছে ?
১. পেটের নির্দিষ্ট অংশ ফুলে যাওয়া।
২. পেটের নির্দিষ্ট অংশে প্রবল ব্য়থা হওয়া ।
৩. কাশি দিতে গেলে ব্য়থা বেড়ে যাওয়া।
৪. পেটের নির্দিষ্ট অংশটা জ্বালা-পোড়া করা।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হার্নিয়া শরীরে নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে হার্নিয়াতে ব্যথা না হতেও পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমদিকে এই সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলে অনেক সমস্যা দূর হতে পারে।
হার্নিয়ার চিকিৎসা কি ?
হার্নিয়ার চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার। তবে হার্নিয়ার প্রকৃতি, রোগীর সক্ষমতা, কো–মরবিডিটি যেমন ডায়াবেটিস, স্থূলতা ইত্যাদি বিবেচনা করে সার্জন কখন অস্ত্রোপচার করবেন, সে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
বর্তমানে বেশির ভাগ হার্নিয়াই কেটে অথবা আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে ফেলে দেওয়া যায় যায়। আধুনিক পদ্ধতিতে হার্নিয়ার অস্ত্রোপচার অনেক ব্যয়বহুল।
অস্ত্রোপচারের সময় হার্নিয়ার কনটেন্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেগুলো আবার ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেটেও ফেলা যেতে পারে। এরপর হার্নিয়ার ক্ষতস্থানে একটি সিনথেটিক বা সেমিসিনথেটিক ম্যাশ বসিয়ে দেওয়া হয়। এটি দেখতে অনেকটা মশারির জালের মতো।
তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে, যেমন শিশুদের হার্নিয়া কিংবা জরুরি হার্নিয়া অস্ত্রোপচারের সময় অথবা যদি কোনো নারী গর্ভধারণ করতে চান, তাদের হার্নিয়া ম্যাশ ছাড়া শুধু টিস্যু মেরামতের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করে দেওয়া হয়।
অস্ত্রোপচারের পর যেন সংক্রমণ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, ম্যাশে সংক্রমণ হয়ে গেলে সেটা রোগী ও চিকিৎসক দুজনের জন্যই ভীষণ ভোগান্তির বিষয়। মূলত ডায়াবেটিসের রোগী বা স্থূলকায় রোগীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। তাই অস্ত্রোপচারের আগে ডায়াবেটিস ও স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
আরেকটা সমস্যা হলো, হার্নিয়া পুনরায় হওয়া। যদিও ম্যাশ ব্যবহারের ফলে এ ঝুঁকি এখন অনেক কমে গেছে। তবে তার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।
হার্নিয়া অপারেশনের পর করনীয়—
বর্তমানে ল্যাপারোস্কপিক অপারেশনে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে।২-৩ দিনের মধ্যে বাড়ি চলে যেতে পারে।তবে কিছুদিন ভারী কাজ করা যাবে না।অপারেশনের জায়গা নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে।যাতে ইনফেকশন না হয়।
হার্নিয়ায় চিকিৎসা না করালে কি সমস্যা হতে পারে ?
হার্নিয়া অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক না করলে, একটি মারাত্মক ঝুঁকি হলো— এটি পেটের দেয়ালের বাইরে আটকে গিয়ে ঘা-এর সৃষ্টি করতে পারে, যাকে ইনকার্সেরেটেড হার্নিয়া বলা হয়। ফলে হার্নিয়াতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে ও অন্ত্রের মধ্যে খাদ্য চলাচলে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। যাকে প্যাঁচালো বা স্ট্র্যাংগুলেটেড হার্নিয়া বলা হয়। এ ক্ষেত্রে অপারেশন জরুরি হয়ে পড়ে। সব হার্নিয়াই যে এই ঝুঁকিতে পড়বে তা নয়, তবে এটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ধরনের একটি অতিজরুরি অবস্থা, যা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেই অবস্থায় যেন আপনি না পড়েন সে জন্য হলেও হার্নিয়া অপারেশনে বিলম্ব করা উচিত নয়।
হার্নিয়া হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা —–
এর একমাত্র চিকিৎসা হল সার্জারী।কোন এলোপ্যাথিক বা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়ে এটার চিকিৎসা সম্ভব নয়।
হার্নিয়ার ভেষজ চিকিৎসা——
এর কোন ধরণের ভেষজ বা কবিরাজি চিকিৎসা নেই।এগুলো সব প্রতারণা,এর মাধ্যমে শুধু রোগীর ক্ষতিই হবে।
হার্নিয়া থেকে কিভাবে বেঁচে থাকবেন ?
# হার্নিয়ার মতো বিব্রতকর ও জটিল সমস্যা থেকে বাঁচতে চাই নিয়মিত ব্যায়াম আর সুস্থ খাদ্যাভ্যাস।
# ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
# জোরে চাপ দিয়ে পায়খানা-প্রস্রাব করা যাবে না।
# জোরে হাঁচি–কাশি দেওয়া থেকেও বিরত থাকার চেষ্টা করা উচিত।
# পেটের যে কোনো অস্ত্রোপচারের পর, বিশেষত সিজারের পর, কিছুদিন বেল্ট ব্যবহার করা ভালো। তাতে ক্ষতস্থানে চাপ কম পড়ে। আর অস্ত্রোপচারের পর মাসখানেক ভারী কিছু না তোলাই উত্তম।
# অনেক উঠতি বয়সের যুবক জিমে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভারোত্তলন করে থাকেন। এতে হার্নিয়ার সমস্যা হতে পারে। তাই নিজের সামর্থ্যের বেশি ওজন তোলা উচিত নয়।